রবিবার, ১৯ মার্চ, ২০১৭

মনিষা পৈলান : এসিড সন্ত্রাসে ঝলসানো এক সাহসী কণ্ঠ

মনিষা পৈলান : এসিড সন্ত্রাসে ঝলসানো এক সাহসী কণ্ঠ





অনেকেই নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন যে, বেশ কিছুদিন ধরেই ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসিডে ঝলসে যাওয়া এক নারীমুখের ছবি ভাইরাল হয়ে ঘুরছে। হাতে একটা প্লেকার্ড- আমি মুখ ঢাকবো না। অন্য অনেকের মত আমিও ছবিটা শেয়ার করলাম আমার নিজের ওয়ালে। আমার দেখাদেখি আমার অনেক বন্ধুরাও শেয়ার দিলো। অনেকে তো এই ছবিকে নিজেদের প্রোফাইল পিকচারই বানিয়ে নিয়েছে।

অনেক কিছুতেই আমার তেমন কৌতুহল বা আগ্রহ সচরাচর জন্মায় না। আর একবার যদি কিছুতে আগ্রহ জন্মায় তবে তার মাত্রাটা বরাবরই একটু বেশী হয়। কোন কিছুতে কিংবা কারো বিষয়ে আগ্রহবোধ জন্মালে আমি তার অনেক গভীরে পৌঁছানোর চেষ্টা করি। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। ছবির মুখটির নাম মনিষা পৈলান। নাম লিখে সার্চ দিতেই উনার ফেসবুক আইডি আমার সামনে দেখা দিল। সাহস করে রিকোয়েস্ট পাঠালামও। আর এই ব্যাপারে আমার নিজের কনফিডেন্স লেভেল সম্পর্কে আমার যথেষ্ট দৃঢ় আস্থা আছে যে আমার রিকোয়েস্ট বৃথা যাবেনা। সচরাচর খুব একটা রিকোয়েস্ট কাউকে পাঠাইওনা। অনেক যাচাই-বাছাই করে ভাল লাগলে তবে পাঠাই। আর জানি সেটা বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবেনা, একসেপ্ট হবেই। হয়েছেও আগে, এবারও হলো।

মনিষা পৈলান আমার রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করলেন। উনার প্রোফাইল আর ওয়াল ঘুরে দেখতে শুরু করলাম। আগ্রহটা আরো বাড়লো। যেহেতু লেখালেখির কাজেই জড়িত তাই মনে ইচ্ছা জাগলো উনাকে নিয়েই কিছু একটা লিখি। কিন্তু লিখবো কি? শুধু ˝আমি মুখ ঢাকবো না˝ এনিয়েতো বেশী দূর এগুনো যাবেনা। গোড়া থেকে কাহিনীটা জানতে হবে। সাহস করে উনার ইনবক্সে নক করলাম- আপনাকে নিয়ে লিখতে চাই, সংক্ষেপে যদি আপনার দূর্ঘটনার কাহিনীটা আমাকে বলতেন। খানিকটা অবাক করে দিয়েই তিনি রিপ্লাই দিলেন, কিছুক্ষণ পর বলছি। তারকিছু সময় পরেই তিনি জানালেন কেমন করে কি হয়ে গেল!

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ কলকাতার জয়ানগরের বাসিন্দা মনিষা পৈলান। অন্যসব মেয়েদের মত জীবন কাটছিল স্বাভাবিকভাবেই। সময়টা ছিল ২০১৫ এর নভেম্বর মাস। মাত্র বি.এ কমপ্লিট করলেন মনিষা। পরীক্ষার পরপরই একটা কম্পিউটার সেন্টারে চাকুরীও নিলেন। কিন্তু বখাটে ছেলের কাছে মেয়ের এই স্বাভাবিক চলাটা পছন্দ হবে কেন! একসময় পাশের বাড়ীর এক ছেলে জ্বালাতন শুরু করে দিলো। প্রেমের প্রস্তাব দিলো মনিষাকে। প্রত্যাখ্যান করলেন মনিষা। আর সেটাই কাল হলো মনিষার জীবনে। পরপর আরো কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর একদিন বিকালে পাড়ার আরো চার ছেলের সাথে মনিষার পথ আটকায় তারা। মনিষা তখন অফিস শেষে বাড়ী ফিরছিল। আর তখনই ছেলেটা তার কাছে লুকিয়ে রাখা এসিডের বোতল খুলে এসিড ছুঁড়ে মারে মনিষার মুখ লক্ষ্য করে। মুহুর্তেই ঝলসে যায় মনিষার মুখমন্ডল। মারাত্মক আহত অবস্থায় মনিষাকে উদ্ধার করে নেয়া হয় হাসপাতালে। মুখের পুরোটাই ঝলসে গেছে। দুই চোখের মধ্যে ডান চোখটা অনেক যুদ্ধ করে রক্ষা করতে হয়েছিল। যথারীতি পুলিশ কেইস হলো। মূল আসামী ধরা না পড়লেও বাকী ছেলেগুলো পুলিশের হাতে আটক হয়। মামলা কোর্টে উঠে। একসময় ঐ চার ছেলেও জামিনে মুক্ত হয়ে যায়। এখন মনিষার চোখের সামনেই ঘুরে বেড়ায় তারা। মূল আসামীর কথা পুলিশের কাছে জানতে চাইলে পুলিশ জানায়, হয়তো দেশের বাইরে চলে গেছে তাই ধরা  যাচ্ছেনা। অথছ দেশেই আছে ছেলেটা।

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে চিকিৎসা শেষে মনিষা আবার ফিরে এলো। কিন্তু এবার শুরু হলো মনিষার জীবনের অন্য আরেক কঠিন অধ্যায়। পাড়ার লোকজন বলতে শুরু করলো মনিষাই খারাপ মেয়ে তার চরিত্রের সমস্যা আছে। সেই অপরাধী। নিশ্চয়ই এমন কিছু সে করেছিল যার কারণে ঐ ছেলে ক্ষিপ্ত হয়ে এইকাজ করেছে। নানা ধরণের অপবাদের বাণে জর্জরিত করে তুলছিল সমাজের লোকেরা। বাঁচার আগ্রহটাই যেন হারাতে বসেছিল মনিষা। কিন্তু না, হার মানেননি মানিষা পৈলান। নতুন করে ফিরে দাঁড়ালেন। এখন আবার ভর্তি হয়েছেন মাষ্টার্স এ। 

মনিষার কাহিনীতে হয়তোবা বিশেষ এমন কিছু নেই যা কাউকে ততোটা আগ্রহী করে তুলতে পারে তার ব্যাপারে। এসিডের শিকার হওয়া নারী ভারত-বাংলাদেশে আরো অনেকেই আছেন। তাদের অনেকেই আবার প্রতিষ্ঠিতও হয়েছেন। কিন্তু আমি আগ্রহী হয়েছি, আগ্রহী হয়েছিলাম উনার মুখ না ঢাকবার দৃঢ় সংকল্প দেখে। এর আগে কোন এসিডের শিকার কে দেখিনি মুখ খোলা রেখে চলাফেরা করতে। ওড়না বা অন্য কিছু দিয়ে ঝলসানো মুখ আড়াল করেই বাকীরা জীবনযাপন করছেন। আর মনিষার এই ব্যতিক্রমটাই আমাকে আগ্রহী করে তুলেছিল মনিষা সম্পর্কে। সত্যিই তো। মনিষা কেন মুখ ঢেকে চলবে? মুখ ঢেকে যদি চলতেই হয় তাহলে অপরাধী যারা তারা ঢাকবে। মনিষা জানালেন, এসিডে আমার চোখ মুখ ঝলসে গেছে,  চেহারা হয়ে গেছে বিকৃতি। এ কারণে জীবনে অনেক দূর্ভোগ পোহাতে হয়েছে আমার। কিন্ত   একটুও দমিনি আমি। এত লাঞ্ছনা সহ্য করেও ভাবিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে। প্রথম প্রথম কাউকে না পেলেও এখন আমার পাশে অনেকেই আছেন। অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি দেয়ার জন্য যা যা করণীয় তার সব আমি করবোই। মনিষার এই দৃঢ় সংকল্প নিশ্চয় অনুপ্রাণিত করবে আরো অনেককেই।

নারীর প্রতি সহিংসতার নৃশংসতম একটি ধরন হচ্ছে এসিড নিক্ষেপ। এসিড সন্ত্রাসের পরিণতিতে একজন নারীর শারীরিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয় তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কারো পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। আমরা এক্ষেত্রে শুধু সহানুভূতি জানাতে পারি, সমব্যাথী হওয়া সম্ভব নয়। এসিড নামক রাসায়নিক এই  দাহ্যপদার্থটির ভয়াবহতা এত ব্যাপক যে এটি চামড়ার নিচের টিস্যু, এমনকি  হাড়ও গলিয়ে দিতে সক্ষম। এসিড সন্ত্রাসের যে কোনো ঘটনা মানবিক চেতনাকে আহত করে।

ভারতের মতো দেশে যেখানে নারী ধর্ষণের ঘটনা নিত্য সেখানে এসিড নিক্ষেপের কথা নতুন নয়, অত্যন্ত স্বাভাবিক। এসিড হামলার ক্ষেত্রে ভারতে পুলিশ ও প্রশাসনের মনোভাবের কড়া সমালোচনার কথাও শোনা যায়। অপরাধীদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও তাদের শাস্তি দেওয়ার বিষয়ে পুলিশ গড়িমসি করে। আদালতে মামলাও সহজে শেষ হতে চায় না। ভারতে এ বিষয়ে এখনো যথেষ্ট সচেতনতার অভাব রয়েছে। কর্তৃপক্ষও সময় নষ্ট করছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এসিড বিক্রির ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার নির্দেশ দেয়ার পরও এখনো সেখানে সহজেই এসিড কেনা যায়। বাংলাদেশে এসিড সন্ত্রাসজনিত অপরাধকে এখন যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এর জন্য করা হয়েছে কঠোর শাস্তির বিধান। কিন্তু আইন যথেষ্ট হলেও যথাযথ প্রয়োগের বিষয়টি সেভাবে পুরোপুরি নিশ্চিত করা না গেলেও বাংলাদেশে এসিড সন্ত্রাস এখন অনেকখানিই নিয়ন্ত্রণে আছে বলা যায়। সেই তুলনায় ভারতীয়রা অনেক পিছিয়ে রয়েছে।  

আমরা আশা করবো খুব দ্রুত মনিষার মূল আসামীকে কলকাতা পুলিশ প্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসবে। বিচারান্তে উপযুক্ত সাজা পাবে মূল আসামী ও তার সহযোগী দোসরেরা। মনিষার আগেও আরো অনেক ভারতীয় নারী এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছিল। উল্লেখযোগ্য যে বলিউড অভিনেত্রী কঙ্গনার এক বোনও এর শিকার হয়েছিল, আলোচিত হয়েছিলেন লক্ষ্মী নামের এক নারীও যিনি পরবর্তীতে এসিড আক্রান্তদের নিয়েই কাজ করতে শুরু করেন। এর জন্য আন্তর্জাতিকভাবে পুরষ্কৃতও হয়েছিলেন লক্ষ্মী। অনেকের মামলার রায় শেষে আসামীরা সাজা খাটছেন, অনেকের আবার মামলা চলমান রয়েছে। এসিড সন্ত্রাসের প্রতিটি মামলা যেন গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয় এবং যথাযথ তদন্ত ও আইনী কারবার শেষে প্রতিটি আসামীর উপযুক্ত সাজা নিশ্চিত হোক- এটাই আমাদের সকলের প্রত্যাশা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মনে রাখবেন: এই ব্লগের কোনও সদস্যই কোনও মন্তব্য পোস্ট করতে পারে৷

What you say What you do, Think twice before...

- দোস্ত ! দেখ মালডা চরম না ?? - কোনটা ? ও...এইডা ! এইডার কথা কইতে পারিনা, তয় তোগোর বাড়িতে একটা চরম মাল  আছে ! - আমাগোর বাড়িতে ! ক...